বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেবেন না দিল্লির মাওলানা সাদ

বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেবেন না দিল্লির মাওলানা সাদ

বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেবেন না দিল্লির মাওলানা সাদ। বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) ডিএমপি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনারের বরাত দিয়ে যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় (ক্রাইম) এ কথা জানান।

কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করে মুসল্লিদের দাবির প্রেক্ষিতে এবার ইজতেমায় থাকছেন না মওলানা সাদ। ইজতেমা চলাকালীন পুরো সময়টিতেই মওলানা সাদ অবস্থান করবেন কাকরাইল মসজিদে। সেখানে যে কোন ধরণের বিক্ষোভ, অপ্রীতিকর ঘটনা, নিরাপত্তার স্বার্থে মোতায়েন থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেবেন না দিল্লির মাওলানা সাদ

‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের কারণে ভারতের নিজামুদ্দিনের আমির মাওলানা সাদকে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে না দেয়ার উদ্দেশ্যে বুধবার বিমানবন্দর এলাকায় বিক্ষোভ করে মুসল্লিরা। মাওলানা সাদ যেন ইজতেমায় যোগ না দিতে পারেন, সে দাবিতে শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার এর প্রিন্সিপাল মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদের নেতৃত্বে চলে বিক্ষোভ।

বিক্ষোভ থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, মাওলানা সাদকে ইজতেমায় যোগ দেয়া থেকে বিরত না করলে শাপলা চত্বরের মতো ঘটনা ঘটবে।
সেসময় বিক্ষোভকারী বাংলাদেশি মুসল্লিদের অবস্থানের কারণে কয়েক ঘণ্টা বিমানবন্দর এলাকায় যান চলাচল বন্ধ থাকলেও বেলা ৩টার পর থেকে এক পাশের রাস্তা এবং উল্টো দিকের রাস্তার একটি লেন খুলে দেয়া হয়। দিনভর বিক্ষোভের মধ্যে হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কঠোর নিরাপত্তায় ভারতের নিজামুদ্দিনের আমির মাওলানা সা’দকে কাকরাইল মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়।

ভারতীয় মাওলানা সাদ যে কারণে বিতর্কিত : তাবলিগ জামায়াতের এক পক্ষের দাবি শতবছর আগে দ্বীন ও ইসলামের দাওয়াতি কাজকে ত্বরান্বিত করতে মাওলানা ইলিয়াছ শাহ (রাহ.) দিল্লির নিজামুদ্দিন মসজিদ থেকে তাবলিগের কাজ শুরু করেন। মাওলানা ইলিয়াছ (রাহ.)-র ছেলে মাওলানা হারুন (রাহ.)। তারই ছেলে হলেন মাওলানা সাদ কান্ধলভী। দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরব্বি সাদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কুরআন, হাদিস, ইসলাম, নবি-রাসুল, নবুয়ত ও মাসআলা-মাসায়িল নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেমদের কাছে বিতর্কিত হয়েছেন। তার বিতর্কিত মন্তব্যগুলো ‘সা’আদ সাহেবের আসল রূপ’ নামে একটি ছোট্ট বই আকারে প্রকাশ করেছেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস, তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি এবং দ্বন্দ্ব নিরসনে ভারত সফরকারী ৫ সদস্যের অন্যতম মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক।

তার লিখিত ‘মাওলানা সাদ সাহেবের আপত্তিকর’ কুরআন-হাদিসবিরোধী বক্তব্যগুলো হচ্ছে (১) ভাট দেয়া থেকে বিরত থাকা, অর্থাৎ ভোটের সময় চিহ্ন হিসাবে (আঙুলে) যে রং লাগানো হয়, তার কারণে নামাজ হয় না। আর এজন্যই ভোট না দেয়া উচিত। (২) কুরআন শরীফের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান, তিনি বিভিন্ন আয়াত নিয়ে বলেছেন, মুফাসসিরিন এ আয়াতের কোনো এক তাফসির করেছেন, ওলামা কোনো এক তাফসির করে থাকেন, কিন্তু আমি এই তাফসির করে থাকি। এটা শুনো। এটাই সঠিক তাফসির! (৩) ইসলাম ও ওলামাদের বিরোধিতা, অর্থাৎ ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রাখা হারাম এবং পকেটে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রেখে নামাজ হয় না। যে আলেমগণ ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রাখাকে ‘জায়েজ’ বলেন, তারা ‘ওলামায়ে ছু’।

বারবার কসম খেয়ে তিনি বলেন, তারা হলো ‘ওলামায়ে ছু’। এমন আলেমরা হলো গাধা! গাধা! গাধা! (৫) নম্বরে বলা হয়েছে, জাহেলি ফতোয়া অর্থাৎ মোবাইলে কুরআন শরীফ পড়া এবং শোনা, প্রস্রাবের পাত্র থেকে দুধ পান করার মতো! আর (৬) নম্বরে হচ্ছে, মাদরাসা মসজিদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়ে খারাপ, কুরআন শরিফ শিখিয়ে বেতন গ্রহণ করেন, তাদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়েও খারাপ। যে ইমাম এবং শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন, বেশ্যারা তাদের আগে জান্নাতে যাবে! (৭) নম্বর হচ্ছে কাওমি মাদরাসা বন্ধ করার অপচেষ্টা : মাদরাসাগুলোতে জাকাত না দেয়া হোক। মাদরাসায় জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না।

এছাড়া, আওলিয়াদের সঙ্গে শত্রুতা সংক্রান্তে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কেবল তিনজন লোকের ‘বাইআত’ পূর্ণতা পেয়েছে। আর বাকি সবার বাইআত অপূর্ণ। সেই ৩ জন হলেন- শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস এবং মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ। আবার (৮) নম্বরে সুন্নাত সম্পর্কে জাহেলি মন্তব্যও করা হয়েছে, তা হচ্ছে, মাওলানা সাদ সাহেব আযমগড়ের ইজতেমায় এবং অন্যান্য ইজতেমায় একাধিকবার সুন্নাতকে ‘৩ প্রকার’ বলে বর্ণনা করেছেন- ইবাদতের সুন্নাত, দাওয়াতের সুন্নাত এবং আচার-অভ্যাসের সুন্নাত। এছাড়া, নবিওয়ালা কাজের বিরোধিতা ‘দাওয়াতের পথ’ হলো নবির পথ, ‘তাসাউফের পথ’ নবির পথ না। আর ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আজান হলো ‘তাশকিল’ (প্ল্যান-পরিকল্পনা)। নামাজ হলো ‘তারগিব’ (পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধকরণ)। আর নামাজের পর আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া হলো ‘তারতীব’ (পরিকল্পনার মূল বাস্তবায়ন)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতে ইলাল্লাহর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইশার নামাজকে পর্যন্ত বিলম্ব করে পড়েছেন। অর্থাৎ নামাজের চেয়ে দাওয়াতের গুরুত্ব বেশি বলা হয়েছে।

এছাড়া, জিকিরের অস্বীকার করে বলা হয়েছে, সকাল-সকাল কুরআন তিলাওয়াত করা এবং নফল নামাজ পড়ার তো একটা অর্থ বুঝে আসে। কিন্তু আল্লাহ আল্লাহ বলে জিকির করে কী অর্জন হয়? কিছুই অর্জন হয় না! এই এক তাবলিগই নবুয়তের কাজ। এছাড়া দ্বীনের যতো কাজ আছে- দ্বীনি ইলম শিখানো, দ্বীনি ইলম শেখা, আত্মশুদ্ধি, কিতাবাদি রচনা করা কোনোটাই নবুয়তের কাজ না। এছাড়া আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তিকর আলোচনা বা মতামত প্রকাশ করেছেন।

উল্লিখিত এসব কুরআন-হাদিস বহির্ভূত আলোচনার জন্য ওলামায়ে দেওবন্দসহ বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম আলেমগণ তার ক্ষমা চাওয়া এবং তাওবার আহ্বান জানান। আর এসব গোমরাহী কথা-বার্তার অডিও রেকর্ড দারুল উলুম দেওবন্দে সংরক্ষিত রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্ত তাবলিগ জামায়াতের কাকরাইলস্থ একাধিক মুরুবিব জানিয়েছেন, মাওলানা সাদ তার দাদা হজরত ইলিয়াস শাহ (রাহ.)সহ আকাবির আলেমদের মেহনতে তৈরি দাওয়াত ও তাবলিগের ময়দানে ভক্তি দেখিয়ে আম মানুষের জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

কিন্তু মাওলানা যুবায়রুল হাসান রহ.-এর ইন্তেকালের পর পরই মাওলানা সাদ সাহেব তার এ বিতর্কিত-আপত্তিকর মন্তব্য ও বক্তব্য তুলে ধরে আসল রূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন বলে মাওলানা সাদবিরোধীরা জানিয়েছেন। এসব বিষয়ের কারণেই বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে মালয়েশিয়ায় নেওয়ার হুমকি দেন মালয়েশিয়া তাবলিগের শূরা কর্তৃপক্ষ। গত রোববার বাংলাদেশ তাবলিগ জামাতকে লেখা এক চিঠিতে এ হুমকি দেয়া হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।

গাজীপুরের টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদকে ইজতেমার আমির ও ফয়সালার (সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী) পদ থেকে সরানো হলে এ পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে এক চিঠিতে সতর্ক করা হয়েছে। আর তাবলিগ জামায়াতের কানাডা শূরার সদস্য আবির রশিদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘টঙ্গী ইজতেমায় নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদের অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে আমরা জেনেছি।

দিল্লির নিজামউদ্দিন মসজিদ থেকে শতবর্ষ আগে তাবলিগ জামাতের এই যাত্রা ও প্রসারের ক্ষেত্রে মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস (রহ.)-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও দোয়ার কথা বিশ্ববাসী জানে। তিনি জীবিত থাকতে প্রতিবছর এ মারকাজের উত্তরসূরি মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ (রহ.), মাওলানা ইনামুল হাসান (রহ.) মাওলানা জুবায়েরুল হাসান (রহ.) টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। এখন তাদের উত্তরসূরি হিসেবে আসছেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ।’

আর টঙ্গীর ইজতেমা কেবল লাখো মুসল্লির জমায়েতই নয়, এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবীণ নীতি-নির্ধারকদের মিলনমেলাও। যারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানুষের শান্তি ও কল্যাণের স্বার্থে কাজ করেন। আর পুরো তাবলিগের ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, টঙ্গীসহ এ ধরনের ইজতেমার দায়িত্বভার নিজামউদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরিদের ওপরই থাকছে, যেটা কবছর ধরে অত্যন্ত সুচারুভাবে পালন করে আসছেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ। ‘তারই ধারাবাহিকতায় কিছু লোক তার বিরোধিতা করলেও সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর মতো কানাডার শূরাও কেবল নিজামউদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরি হিসেবে মাওলানা সাদকে আমির ও ফয়সাল হিসেবে গ্রহণ করবে।

এই অবস্থায় বাংলাদেশ শুরা যদি অতীতের রেওয়াজ ভেঙে নিজামউদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরিকে দায়িত্বভার থেকে সরিয়ে দেয়, তাহলে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে, আর সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই। এমন কিছু হলে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ২০১৮সালকে বিশ্ববাসী মনে রাখবে।’ মালয়েশিয়া শূরার সতর্কবার্তায় আরো বলা হয়, আয়োজকরা যদি নিজামুদ্দিনের প্রতিনিধিদের থেকে আমির ও ফয়সাল নির্বাচনের মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য মানতে ব্যর্থ হন, তাহলে বাংলাদেশের বদলে মালয়েশিয়ায় বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের প্রস্তাব করা হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment